ধর্ম ডেস্ক: মুসলিম বিশ্বের মহিমান্বিত মাস রমজান। এ মাস ঘিরে নানা অনুষ্ঠান আর রীতি-রেওয়াজ আছে। রোজা রাখা, ইফতারের পর তারাবির নামাজ পড়া ইত্যাদি ছাড়াও আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয় খুশির আমেজ। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের চেয়েও এসব রীতি সাংস্কৃতিক উদযাপন হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। মহাদেশীয় ইউরোপের উত্তর-পশ্চিম উপকূল থেকে কিছু দূরে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থিত দেশ বৃটেন। সেখানে কীভাবে রমজান পালিত হয়, তা জানাচ্ছেন মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
২.৭ মিলিয়ন মুসলমান
ব্রিটেনের মোট জনগোষ্ঠীর ৩ শতাংশ মানুষ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা পালন করেন। বলা হয়, ব্রিটেনে প্রায় ২.৭ মিলিয়ন মুসলমানের আবাস। এই আড়াই মিলিয়নেরও অধিক মানুষই যেন এ সময়টাতে বদলে দেয় ব্রিটেনের অনেক শহরের চিত্র। মোট জনসংখ্যার মাত্র এক চতুর্থাংশ ব্রিটিশদের এ মাস সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকলেও মুসলিম কমিউনিটিতে এ সংযমের মাসটা আসে যেন উৎসবের উপলক্ষ হয়ে।
সাজ সাজ রব
রমজান মূলত সংযমের মাস। কিন্তু সারা পৃথিবীতেই মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে এই মাসটাই যেন হয়ে ওঠে অধিক মাত্রায় খরচের একটা মাস হিসেবে। এক ধরনের সাজ সাজ রব আছে, বাড়তি খরচ, ইফতারের আয়োজনে মানুষের দোকানে দোকানে ঢুঁ মারা। ব্রিটেনের সুপার মার্কেটগুলোও যেন প্রতিযোগিতায় নামে। টেসকো, সেইন্সবারি, আসদা প্রভৃতি ব্যবসা কেন্দ্রগুলোতে হালাল ফুডের প্রদর্শনী ও বিক্রি বেড়ে যায়। এমনকি স্থানীয় কামউনিটি চ্যানেল থেকে শুরু করে মূলধারার গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন পর্যন্ত প্রদর্শিত হয়।
ইফতারে আড্ডার মোক্ষম সুযোগ
রমজান মাসকে উপলক্ষ করে ধনাঢ্যরা মেতে ওঠেন লোক দেখানো জাকাত প্রদানে। নিম্ন মূল্যের শাড়ি আর লুঙ্গি দিতে গিয়ে প্রাণ নেন কিছু মানুষের। একদিকে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার আকুতি, বস্তিতে নিরন্ন মানুষ, অন্যদিকে ইফতার-সেহরির অর্ধশতাধিক বিলাসী আইটেম দিয়ে রমজানকে আসলে সম্মান দেখানো হয় না, বরং এক ধরনের অপমান করা হয় ওই মানুষদের। ব্রিটেনে অবশ্য এ রকম পার্টি এখনও সংস্কৃতিতে রূপ নেয়নি। তবে ইফতারের তোড়জোড় আছে। বিলাসী ইফতারে ছেয়ে যায় সভা-সমাবেশ। সামাজিক সংগঠনগুলোর জন্য এ এক উপলক্ষ, বন্ধু-সজ্জনদের নিয়ে আড্ডা দেওয়ার এক মোক্ষম সুযোগ।
অর্থনীতিতে রমজানের প্রভাব
রমজানের শুরুতে ব্রিটেনের স্কাই টিভি চ্যানেল একটি রিপোর্ট করে। সেখানে দেখানো হয়েছে, কীভাবে ব্রিটেনের অর্থনীতি প্রভাবিত হয় রমজান মাসকে কেন্দ্র করে। দেশটির সুপার মার্কেটগুলো নতুনভাবে সাজায় তাদের সেল কিংবা মূল্যছাড়ের পদ্ধতি। অথচ মুসলিম নেতারা দাবি করছেন, সুপার মার্কেটগুলো যদি এশিয়ান ‘ক্যাশ এন্ড ক্যারি’র মতো ডিসপ্লে রাখত কিংবা বিক্রির ব্যবস্থা করত, তাহলে শুধু এ মাসেই ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড অতিরিক্ত ব্যবসা করতে পারত সুপার স্টোরগুলো।
অর্থ সংগ্রহের উৎসব
রমজানকে কেন্দ্র করে অর্থ সংগ্রহেরও উৎসব শুরু হয় ব্রিটেনে। রাস্তায়, ট্রাফিক জ্যামে টিন কিংবা পট নিয়ে ভদ্র আর শালীন আহ্বান- সিরিয়া-রোহিঙ্গা প্রভৃতি শব্দ দিয়ে আবেগী সাহায্যের আকুতি। চ্যারিটি কর্মীরা হাজারো-লাখো পাউন্ডের চাঁদা সংগ্রহ করছে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একজন ব্রিটিশ ব্যবসায়ীও অর্থ সংগ্রহ করেছেন এই ব্রিটেনে। তার প্রতিষ্ঠানে চ্যারিটি ডিনার করেছেন।
সময়সূচিতে বদল
ব্রিটেনের মুসলমান শিক্ষার্থীরা যাতে রমজান মাসে রোজা রেখেও ভালোভাবে পরীক্ষা দিতে পারে, সেজন্য দেশটির সরকার পরীক্ষার সময়সূচিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। নতুন মৌসুম থেকেই এ নতুন সময়সূচি কার্যকর হয়। ব্রিটিশ সরকারের পরীক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ‘জিসিএসই এবং এ লেভেল পর্যায়ে যে বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেশি, যেমন—ইংরেজি ও গণিত, সেখানে মুসলমান শিক্ষার্থীরা আগেভাগে পরীক্ষা দিতে পারবে। এমনকি মুসলমান ছেলেমেয়েরা যাতে রোজা রেখে দিনের শুরুতেই পরীক্ষাটা দিয়ে ফেলতে পারে, সেই ব্যবস্থাও করা হয়েছে ।
সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, ‘স্কুলের ছাত্র, শিক্ষক এবং অভিভাবকদের তরফে দাবি ওঠার পরই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’ অভিভাবকরা প্রায়ই অভিযোগ করে থাকেন, ‘ব্রিটেনে একদিনে রোজা রাখার সময় ১৮-২০ ঘণ্টাও হয়। এত লম্বা সময় ধরে রোজা রাখার ফলে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়ে। ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পরীক্ষার ওপর।’
পরীক্ষার সময়সূচিকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে ব্রিটেনের প্রধান শিক্ষকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব স্কুল অ্যান্ড কলেজ লিডার্স। এর সভাপতি ম্যালকম ট্রব বলছেন, ‘মুসলমান শিক্ষার্থীরা যাতে ভালোভাবেই রোজার মাসটি পালন করতে পারে, সেজন্য আমরা তৎপর।’